মোট পৃষ্ঠাদর্শন

শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৩

চোর

১.
হলের মাঠে একটা চোরকে পেটানো হচ্ছে সমানে। সিনিয়র ব্যাচের রাশেদ ভাই বেশ আগ্রহের সাথে কাজটা করে যাচ্ছেন। অন্য ব্যাচের ছেলেরাও চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। হলে চুরির ঘটনা নতুন কিছু না। দুই দিন আগেও হার্ডডিস্ক আর সিপিইউ চুরির মত ঘটনা ঘটেছে। তার আগের সপ্তাহে মোবাইলও চুরি গেছে বেশ কয়েকটা। কিন্তু চোরটাকে ধরা সম্ভব হয় নি এতদিন। ব্যাটাকে আজ হাতেনাতে ধরা গেছে অনেক কষ্টে। খুব সহজে রেহাই পাবে বলে মনে হয় না। রাশেদ ভাই মোটা একটা ডান্ডা দিয়ে পিটিয়ে যাচ্ছেন অনবরত। হাত পা ফুলে গেছে চোরটার। কিন্তু রক্ত বের হওয়ার কোন নাম গন্ধ নাই। জুনিয়র ব্যাচের ছেলেগুলো বিরক্ত হয় ভীষণ। এভাবে মেরে কি লাভ? হারামজাদার হাত পা ভেঙে দেয়া দরকার !  আসিফ নামের একটা ছেলে শার্টের হাতা গুটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসে, "ভাই, শুয়োরের বাচ্চার মাথায় দুইটা বাড়ি দেন, ঝামেলা শেষ"। রাশেদ ভাইয়ের রক্ত গরম হয়ে যায় আরো। এবার হাত আর পায়ের গিরায় মারতে থাকেন সজোরে। চোরটা আর্তনাদ করে উঠে, "বাবাগো", "মাগো" বলে মূর্ছা যায় বারবার। অবশ্য এই শিক্ষিত, ভদ্র সমাজের কেউ সেটা গায়ে মাখে না।

দুপুরের গনগনে সূর্যটাও একসময় মাথার উপর এসে থমকে দাঁড়ায়। ততক্ষনে চোরটার মাথা ফেটে বেশ কয়েকবার রক্ত ঝরেছে, আবার শুকিয়েও গেছে। চারটা হাত পা-ই সম্ভবত ভেঙে দেয়া হয়েছে, কোনটাই অবশিষ্ট থাকেনি আর। মুখ দিয়ে ক্রমাগত ফেনা বের হচ্ছে বেচারার, আগের মত আর চিৎকার চেঁচামেচিও করছে না। একেবারে নিথর হয়ে পড়ে আছে ঘাসের উপর। রাশেদ ভাই থামলেন অনেকক্ষন পর। ডান্ডাটা ছুড়ে ফেললেন সামনের দিকে। তারপর পায়ের স্যান্ডেলটা মেঝেতে ঘষে একটা বিশ্রী শব্দ করতে করতে হলের ডাইনিংয়ে ঢুকলেন। অনেকদিন পর নিজেকে ভীষণ সাহসী মনে হয় তার। একটা আত্মতুষ্টির অনুভূতিও হয় ভেতরে ভেতরে। কিন্তু সেটা আর বেশিক্ষন থাকে না, মুরগীর পিস্‌টা দেখে মেজাজ বিগড়ে যায় ভীষণ। অন্যদিন হলে চুপচাপ খেয়ে নিতেন। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা আলাদা। আজকে তাই নুরু ভাইকে ডাকলেন চিৎকার করে। তারপর বেশ একটা ঝাড়ি দিলেন। মাগনা তো আর খান না। মাসে মাসে এতগুলা টাকা দিতে হয়। মুরগীর এইরকম পিস্‌ দেখলে মেজাজ তো একটু খারাপ হতেই পারে !

বিকেলের দিকে খবরটা হলে আসল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছে চোরটা। খবরটা যখন হলে আসে তখন সবার খারাপ লাগতে থাকে একটু একটু। এতটা না মারলেও হয়ত চলত ! কত আর বয়স হবে বেচারার ? বাইশ তেইশ হবে হয়ত ! নিশ্চয়ই খুব অভাবে পড়ে কাজটা করতে গেছে। গত দুইদিন ধরে হয়ত কিছুই খায়নি। কিংবা কে জানে, ছোট বোনটার বিয়ের জন্য হয়ত অনেকগুলো টাকা দরকার ছিল ! সেটা জোগাড়ের জন্যই হয়ত কাজটা করেছে। রাশেদ ভাইয়ের অবশ্য তেমন কোন ভাবান্তর হয় না। এইসব ছোটলোক দুনিয়া থেকে চলে গেলেই ভালো। দুনিয়ার মানুষগুলো ভালো থাকে তাহলে ! হলের গেইটে দাঁড়িয়ে মাঝবয়সী এক মহিলা কাঁদছিলেন অনেকক্ষন ধরে। সম্ভবত চোরটার মা। সেই কান্না যে কারো ভেতরটা ভেঙে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। যে কারো চোখে দু'ফোটা অশ্রু আনার জন্য যথেষ্ট। আর তাই একটু আগেও যে ছেলেগুলো অমানুষিকভাবে পেটাচ্ছিল চোরটাকে, তারাও শার্টের হাতায় চোখদুটো মুছে নিলো। আসিফ নামের যে ছেলেটা চোরটার মাথায় একটা বাড়ি দিয়ে সব ঝামেলা শেষ করে দিতে চেয়েছিল, সেও পকেট থেকে দশ টাকার একটা ছেঁড়া নোট বের করে সামনে ছুড়ে দিলো। তারপর সদ্য কেনা সিগারেটটার ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বেরিয়ে গেল।  

২.
প্রকৌশলবিদ্যা পাশ করার পর রাশেদ ভাইয়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। এতদিনের যত স্বপ্ন, সব চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল একসাথে। দক্ষিনমুখী দোতলা একটা বাড়ির স্বপ্ন, যে বাড়িটার সামনে ঘাসের একটা বিশাল লন থাকবে। আর সাদা ধবধবে দুটো কুকুরছানা সেখানে ঘুরে বেড়াবে সারাদিন। বিশাল একটা পাজেরো গাড়ি থাকবে বাড়ির সামনে। আর একটা সুইমিং পুল। একটা টেনিস কোর্টও অবশ্য থাকা দরকার। কিন্তু চাকরীর বাজারের যে অবস্থা, তাতে এই স্বপ্নগুলো পূরনের জন্য অন্তত আরো একশো বছর বাঁচা দরকার। ইউরোপ আম্রিকা যাবার ইচ্ছাও রাশেদ ভাইয়ের কোনকালে ছিল না। আর তাই অনেক ভেবেচিন্তে শেষপর্যন্ত একটা উপায় বের করলেন। দেশের সেবা আর নিজের সেবা করার ব্রত নিয়ে দেশে থেকে গেলেন। উগান্ডার প্রেসিডেন্ট আর সোমালিয়ার রাজধানীর নাম মুখস্থ করে রোড্‌স এন্ড হাইওয়েজ ডিপার্টমেন্টে জয়েন করলেন। ভাগ্য ভালো হলে তিন চার বছরেই কোটিপতি হওয়া যাবে হয়ত। আর ভাগ্য যদি সুপ্রসন্ন না হয় ? সেক্ষেত্রেও পাঁচ বছরের বেশি সময় লাগার কথা না। দেশের সেবা আর নিজের সেবা করার এমন সুযোগ জীবনে দুইবার আসে না।  

সরকারী অফিসগুলোর কপর্দকশূন্য অবস্থা দেখে ভেতরটা বোঝার উপায় নেই কোনো। এখানকার ভিখারীসদৃশ মানুষগুলোরও কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। সেটা অবশ্য বাইরে থেকে বোঝা যায় না। রাশেদ ভাইয়ের পোস্টিং হয় যেখানে, সে জায়গাটা আরো বেশি জীর্ণ-শীর্ণ। একেবারে অজপাড়াগাঁয়ে। অপরিষ্কার একটা টেবিল, ভাঙাচোরা একটা চেয়ার আর মাথার উপর অলস ভঙিতে ঘুরতে থাকা ফ্যানসহ একটা নোংরা রুম দেয়া হল তাকে। ভালো লাগার মত একটা কিছুও সেখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারপরও কাঁচা টাকার গন্ধে সবকিছু মেনে নিলেন রাশেদ ভাই। ভীষণ মনোযোগ দিয়ে দেশের সেবা শুরু করলেন।

অল্প কদিনের ভেতর অফিসের কেরানী আবদুল করিমের সাথে বেশ খাতির জমিয়ে ফেললেন রাশেদ ভাই। এক পড়ন্ত বিকেলে, অফিস ছুটির ঠিক আগ মুহূর্তে, দুজনে চা খেতে খেতে দেশ নিয়ে আলোচনা করলেন অনেক্ষন। "দেশটা রসাতলে যাচ্ছে"- এই ধরনের ফালতু কথাবার্তা শুনলে মাথায় রক্ত উঠে যায় করিম সাহেবের। "আরে বাবা, দেশ রসাতলে যাবে কেনো ? আমি ভালো আছি, আপনি ভালো আছেন, আপনার আগে যে ইন্জিনিয়ার সাহেব ছিলেন, উনিও মাশাল্লা ভালো আছেন। দেশ তাহলে রসাতলে যায় কেম্‌নে?" করিম সাহেবের কথায় রাশেদ ভাই অভিভূত হয়ে যান একদম। এত বিচক্ষন মানুষ আগে কোনদিন দেখেন নি তিনি। কি অসাধারন ফিলোসফি ! সত্যিই তো, আমরা ভালো থাকা মানেই তো দেশের ভালো থাকা। এই সহজ জিনিসটাও এতদিনে মাথায় ঢুকল না ! করিম সাহেবের বিপুল ধন সম্পদের কথাও একদিন জানা হয়ে গেল রাশেদ ভাইয়ের। উত্তরায় তার ছয়তলা একটা বাড়ি আছে। মহাখালীতেও চারতলা একটা বাড়ির কাজ চলছে। আর গাজীপুরের দিকে জমি আছে বেশ কয়েক বিঘা। তবে  সবচাইতে অবাক করা ব্যাপার হল, এই ক্লাস এইট পাশ মানুষটার দুই ছেলেমেয়েই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ছে ! "ছেলেটারে ইন্জিনিয়ার আর মেয়েটারে ডাক্তার বানামু স্যার, দোয়া রাইখেন "- রাশেদ ভাই চুপ থাকেন কিছুক্ষন। এরকমটা আশা করেননি তিনি। অবশ্য এই দেশে সবি সম্ভব। রোড্‌স এন্ড হাইওয়েজ এর একজন পিয়ন তার ছেলেমেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াবে, সেটাই স্বাভাবিক !

দেশের সেবা করাটা এত সহজ কিছু হবে সেটা জানা ছিল না রাশেদ ভাইয়ের। হালকা পাতলা কিছু টেকনিক্যাল কাজ ছাড়া সারাদিন তেমন কিছু করার থাকে না আর। কোন একটা প্রজেক্ট পাশ হবার পর নিয়মমত টেন্ডার কল করা হয়। অবশ্য কোন্‌ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটা করবে, সেটা আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। তারপর যখন প্রজেক্টের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা এসে পৌঁছায়, সেই টাকাটা কয়েক ভাগ করা হয়। একটা ভাগ যায় এমপি সাহেবের পকেটে। একটা ভাগ থাকে ইন্জিনিয়ার সাহেবদের জন্য। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আর পুলিশকেও ম্যানেজ করার ব্যাপার আছে। করিম সাহেবদের জন্যও ছোট একটা ভাগ থাকে। সেই ভাগের টাকাও কম না, ছেলেমেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ানোর জন্য যথেষ্ট। এতকিছুর পরেও সামান্য যে কয়টা টাকা থাকে, সেটা দিয়ে কোনরকমে একটা রাস্তা বানানো হয়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই রাস্তাটা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু হয় আবার। দেশের বেকুব বান্দারা কয়েকদিন হা-হুতাশ করে এটা নিয়ে, তারপর ভুলে যায় সব। পুরো ব্যাপারটা একটা সিস্টেমের মধ্যে এসে গেছে। একেবারে সাজানো গোছানো। করিম সাহেব ঠিকি বলেছিলেন, এই দেশের বাতাসে টাকা উড়ে আসলে, সেটা ধরতে জানতে হয় শুধু।

বছর আটেক পর রাশেদ ভাইয়ের বেশ ভালোরকমের একটা প্রমোশন হয়ে যায়। সরকারী বাড়ি গাড়ি পেয়ে যান একসাথে। এটা অবশ্য তেমন কিছুই না। ততদিনে যে পরিমান টাকা কামানো গেছে, সেটা দিয়ে একটা রাজপ্রাসাদ বানানো যাবে রীতিমত। বিলাশবহুল একটা গাড়িও কেনা যাবে। অবশ্য রাজপ্রাসাদ বানানোর কিংবা বিলাসবহুল গাড়ি কেনার কোন ইচ্ছা আপাতত রাশেদ ভাইয়ের নেই। নানারকমের ঝামেলা আছে এই কাজে। তারচাইতে সরকারী জিনিস ব্যবহার করাই ভালো। গাড়িটার সাথে আবার ফ্রিতে একটা ড্রাইভারও পাওয়া গেছে। প্রতি সপ্তাহে এই গাড়ি নিয়ে মাদারীপুর থেকে ঢাকায় যাওয়া হয় বেশ কয়েকবার। যাওয়ার সময় মায়ের জন্য কার্টনভর্তি করে মাল্টা, আপেল, কমলা, আর হরলিকস্‌ নিয়ে যান রাশেদ ভাই। তবে সবচাইতে মজার ব্যাপার হল, এজন্য তার কোন টাকা খরচ করতে হয় না। "সরকারী কাজে তেলবাবদ খরচ"- এর লিস্টে চলে যায় সব। অনেকদিন আগে একটা মুভি দেখেছিলেন রাশেদ ভাই, "লাইফ ইজ বিউটিফুল", সেই মুভির কিছুই বুঝেন নি তখন। কিন্তু এখন বুঝতে পারেন সব। আসলেই, "লাইফ ইজ বিউটিফুল"।

মাদারীপুর থেকে ঢাকা যাবার সময় একবার ভীষণ বিপদে পড়ে যান রাশেদ ভাই। ফেরী পারাপারের ভাড়া দিতে গিয়ে দেখলেন, পকেটে নগদ টাকা একটাও নেই। গাড়ির ড্রাইভার সালামতের পকেটও শূন্য ছিল। গাড়ি থেকে নেমে একটা সিগারেট ধরিয়ে রাশেদ ভাই ভাবতে লাগলেন, কি করা যায়। সালামত এমন সময় মাথা চুলকাতে চুলকাতে সামনে এসে দাড়ায়-
"স্যার, একটা কথা বলতাম, যদি কিছু মনে না করেন........"
"হুমম্‌, বলো"।
"স্যার, বলতেছিলাম কি, অল্প কিছু অক্টেন বেচতে পারলে বেশ কিছু টাকা পাওয়া যাইত........"।

রাশেদ ভাই চমকে উঠেন বুদ্ধিটা শুনে। সামান্য একটা ড্রাইভারের কাছ থেকে এত অসাধারন একটা আইডিয়া পাবেন, সেটা বুঝতে পারেননি আগে। শুধু ফেরী পারাপারের জন্য না, এখন থেকে আইডিয়াটা অন্য কাজেও লাগানো যাবে। বাজারে অক্টেনের দামটাও বেশ ভালো। "তুমি অক্টেন বেচার ব্যবস্থা কর"। ইন্জিনিয়ার সাহেবের কথায় সালামত দ্রুত কাজে নেমে পড়ে। অক্টেন বেচার মত জানাশোনা লোক তার আছে। এই কাজ সে আগেও অনেকবার করেছে। আগের ইন্জিনিয়ার সাহেবরাও তাকে দিয়ে অক্টেন বেচিয়েছে অনেকবার। তবে এত সহজে কেউ রাজি হয় নি আগে। শুরুতে একটু নাটক-ফাটক করত সবাই। তারপর লাইনে চলে আসত। কিন্তু এই ইন্জিনিয়ার সাহেব অন্যরকম, নাটক ফাটকের ধার ধারে না। অনেক বড় ইন্জিনিয়ার হবে হয়ত ! সালামত মনে মনে শঙ্কিত হয় কিছুটা, এই লোক সুযোগ পেলে দেশের একদলা মাটিও রাখবে না, সব বেচে দিবে।

৩.
সামিরা ভাবীর কথা একবারো বলা হয়নি এখনো। রোড্‌স এন্ড হাইওয়েজ এর ইন্জিনিয়ার, আমাদের রাশেদ ভাইয়ের বৌ সামিরা ভাবী। ভীষণ রকমের জেদী আর বদমেজাজী। ধনীর দুলালী হলে যা হয় আর কি ! সচিব সাহেবের এই কন্যা সাজুগুজু করতে পছন্দ করেন খুব। দিনের বেশিরভাগ সময় এসি রুমের ভেতর স্টার প্লাসের সামনে বসে থাকেন ভাবী। বাসার কাজ করার জন্য লোকের অভাব নেই বাড়িতে। রান্নাবান্না, ঘর-দোর মোছা, আর বাগান পরিষ্কারের জন্য বাড়িভর্তি কাজের লোক। অবশ্য তাদের একজনকেও দেখতে পারেন না ভাবী। সবকয়টা ফাঁকিবাজ। শুধু চুরির ধান্ধায় থাকে। শাহীনা নামের কাজের মেয়েটাকে তো আজকে হাতেনাতে ধরেও ফেলেছেন ভাবী। ভাবীর বড় ভাই আমেরিকা থেকে আসার সময় অনেকগুলো দামী পেস্ট্রি কেক নিয়ে এসেছিলেন এবার। আর এই হারামজাদী চুরি করে খাচ্ছিল সেগুলো। শাহীনার চুল টেনে ধরে একটা লোহার রড দিয়ে এলোপাতাড়ি অনেক্ষন মারেন ভাবী। গত সপ্তাহে ভাবীর খুব দামি একটা ঘড়িও চুরি গেছে। ভাবী নিশ্চিত, এই ছোটলোকের বাচ্চাই নিয়েছে সেটা। কিন্তু ঘড়ি চুরির কথা স্বীকার করে না শাহীনা। ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হয় তার, আর একসময় সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যায়। এবার ভাবী ভয় পেয়ে যান সত্যি সত্যি। মরে গেল নাকি আবার ? রাশেদ ভাইকে ফোন করে খুলে বলেন সবকিছু। "আধঘন্টার মধ্যেই পুলিশ নিয়ে আসছি আমি "। রাশেদ ভাই চিন্তা করতে মানা করেন, আর এইসব ছোটলোক, চোর বাটপারকে অভিশাপ দিতে থাকেন অনবরত।

শাহীনার যখন জ্ঞান ফিরল, তখন সে দেখল তার চারপাশে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। স্যার, আপা আর বাড়ির অন্য কাজের লোকেরা। দুইজন পুলিশও দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। শাহীনার কাঁটা ঠোটের রক্ত শুকিয়ে গেছে ততক্ষনে। কিন্তু শরীরটা দুর্বল লাগছে খুব। সে উঠে দাঁড়ায় অনেক কষ্টে। এই পুলিশদের সাথেই এখন তার থানায় যাওয়া লাগবে। আর কিছু করার নেই তার। শাহীনার মাথায় হঠাৎ খুব অদ্ভুত একটা চিন্তা আসে, মনে মনে ঠিক করে নেয় সে, নিজের ছেলেকেও একদিন চোর বানাবে। তবে তার আগে কলম ধরাটা শিখিয়ে দেবে শুধু, যেন মার খেতে না হয় আর !  

 



যখন বৃষ্টি নামত

১.

বাবলুর জন্মের সময় আম্মা মারা যান।

তার আগে আমাদের ছোট্ট একটা সংসার ছিল। আব্বা, আম্মা আর আমি। ভাঙাচোরা একটা বাসা ছিল আমাদের। সেই বাসার দেয়াল আর ছাদ থেকে চুনকাম খসে পড়ত নিয়মিত। জানলার গ্রিলে হাত রেখে দাড়ালে হাত দুটো রাঙা হয়ে যেত। শেওলাধরা কার্নিশের দিকে চোখ পড়লে গা-টা ঘুলিয়ে উঠত। সবচাইতে অদ্ভুত ছিল ঘরের মেঝেটা, কালের বিবর্তনে কিভাবে জানি কতগুলো খানাখন্দ তৈরী হয়েছিল সেখানে। অন্দরমহলের অবস্থাটা ছিল আরো করুণ। একটু এপাশ ওপাশ হলেই বিছানাটা বিচ্ছিরিভাবে আর্তনাদ করে উঠত। ঘুঁণেধরা পড়ার টেবিলটা কাঁপত অনবরত। সামনের বসার রুমটাও সাজানো ছিল হাস্যকরভাবে। যার অন্যতম আকর্ষণ ছিল লাল স্কচটেপ দিয়ে দেয়ালে ঝোলানো একজোড়া চিত্রা হরিণ।

তারপরও সুখে ছিলাম। আব্বা ছোট্ট একটা সরকারী চাকরী করতেন। অল্প কিছু টাকা মাইনে পেতেন। তার পুরোটাই খরচ করতেন আমাদের জন্য। আম্মা সংসারের জন্য অনেক খাটতেন, অসাধারণ ছিল তার রান্নার হাত। প্রতি শুক্রবার পোলাও মাংস রান্না হতো আমাদের বাসায়। একসাথে খেতে বসতাম আমরা। আব্বা হয়ত সেখানে তার অফিসের মিজান সাহেবের গল্পটা বলতেন। আর আম্মা সত্য মিথ্যা মিলিয়ে নানা অভিযোগ করতেন আমার নামে। আমি কিছু বলতাম না, চুপচাপ শুনতাম শুধু। তারপর কথা দিতাম, আর কোনদিন এমনটা হবে না। আর কোনদিন নিয়ম ভাঙবো না, কথার অবাধ্য হব না একরত্তি। কিন্তু সেইসব কথা আর রাখা হতো না, নিয়ম ভাঙতাম নিয়মিত। একেকদিন একেকটা অঘটন ঘটাতাম, আর আমার ছোট্ট মনোজগতটা নেচে উঠত এক অপরিসীম আনন্দে। এতকিছুর পরেও মাঝে মাঝে ভীষণ একা হয়ে যেতাম। সবকিছু কেমন জানি অর্থহীন মনে হতো, শূন্য মনে হতো। অতটুকুন বয়সে এমন দুর্বোধ্য অনুভূতিগুলো কোথা থেকে আসত কে জানে!

আমার একাকীত্ব ঘোচানোর জন্য আব্বা আম্মার চেষ্টার কোন কমতি ছিল না। আব্বা অনেক দামী দামী বই উপহার দিতেন। প্রথম কয়েকদিন সেগুলো পড়তাম না, গন্ধ শুঁকতাম শুধু। তারপর এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করতাম একের পর এক। আমার একাকীত্ব তবু ঘুঁচত না। মন খারাপ করে তাকিয়ে থাকতাম দূরের আকাশটার দিকে। বিকেলের শেষ দিকে ভেন্টিলেটরে বাসা বাঁধা চড়ুইগুলোর ঘরে ফেরা দেখতাম। সন্ধ্যার পর মাঝে মাঝে যখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামত, তখন আম্মার শত বারণ সত্বেও জানলা দুটো খুলে দিতাম। হু হু করে ঠান্ডা বাতাস ঢুকত সেখান দিয়ে। গভীর রাতে হয়ত ঝড় বৃষ্টি থেমে যেত, তখন আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠতাম। জানলার গ্রিল ধরে নিঃশব্দে দাড়িয়ে থাকতাম। পরিষ্কার আকাশে একফালি চাঁদ উঠত তখন। অপলক চোখে তাকিয়ে থাকতাম আমি। মন খারাপ করা চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আমার ভেতরটা শূন্য হয়ে যেত, অকারনে পানি জমত চোখের কোনায়।

একদিন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। আমাদের ছোট্ট সুখের সংসারটা স্তব্ধ হয়ে গেল একদম। কাউকে কিছু না বলে আম্মা চলে গেলেন, আর কোনদিন ফিরলেন না। এত অভিমান হল আম্মার উপর! দুঃখ-কষ্টের পৃথিবীটা ছেড়ে কেমন স্বার্থপরের মতন চলে গেলেন, একটাবারের জন্যও আমাদের কথা ভাবলেন না। আমার কথা, আব্বার কথা, বাবলুর কথা।

বাবলুর দিকে তাকিয়ে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল ভীষণ, নিষ্পাপ মুখটাতে কি অসম্ভব মায়া ছড়ানো! একটা দেবশিশু যেন স্বর্গ থেকে ভুল করে এখানে এসে পড়েছে, হাসপাতালের এই জরাজীর্ণ বিছানায়। এই দেবশিশুটাই একদিন অনেক বড় হবে, আস্তে আস্তে বুঝতে শিখবে সবকিছু। কিন্তু "মা" কি জিনিস সেটা হয়ত আর কোনদিন বুঝবে না। "মাতৃস্নেহ" কি জিনিস সেটা হয়ত আর কোনদিন জানবে না। কয়েকটা দিন আগের ছবিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে আমার। বাবলুকে একটাবার দেখার জন্য কি অপরিসীম অপেক্ষা ছিল আম্মার, কতকিছু বানিয়ে রেখেছিলেন যত্ন করে। আর কতরাত যে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন, সেটাও বা কে জানে? শুধু বাবলু যদি একটাবার জানত! শুধু একটাবার জানত সে যখনও পৃথিবীতে আসে নি তখনও আম্মা তাকে কতটা ভালোবাসতন। বাবলুর আর কোনদিনি জানা হবে না এসব। আম্মার মৃত্যুসংবাদে আমার হাউমাউ করে কান্নাকাটি করার কথা ছিল, কিন্তু আমি সেটা করলাম না। আব্বাকে জড়িয়ে ধরে কয়েক ফোঁটা চোখের জল বিসর্জন দিলাম শুধু। আর জীবনে প্রথমবারের মত আব্বাকে কাঁদতে দেখলাম। আব্বা শিশুর মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন, এত কষ্ট হচ্ছিল আমার!

বাবলুকে দেখার মত আর কেউ অবশিষ্ট থাকল না আমাদের সংসার এ। ছোটখালাকে খবর দেয়া হল। খালা হাসপাতাল থেকে নিয়ে গেলেন বাবলুকে। আর আমি আব্বাকে নিয়ে ঘরে ফিরলাম, একদম নিঃশব্দে।

২.

আম্মা মারা যাবার পর আব্বা বদলে গেলেন, কেমন জানি হয়ে গেলেন দিনে দিনে। আগের মত আর কথা বলেন না, প্রান খুলে হাসেন না। অথচ একটা সময় ছিল যখন অফিস থেকে ফিরেই অস্থির হয়ে যেতেন খুব, অকারনে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করতেন। আম্মাকে ঢেকে বলতেন, "রেণু, গরম এক কাপ চা বানিয়ে দাও তো"। তারপর আমাকে জাগিয়ে তুলতেন ঘুম থেকে। অপরিসীম আগ্রহ নিয়ে শুরু করতেন টিপু সুলতান কিংবা নবাব সিরাজউদ্দৌলার গল্প! আমার ভালো লাগত না মোটেও। এই দুটো ছাড়া আর কোন গল্প জানতেন না আব্বা। চুপচাপ বসে শুনতাম একেকটা গল্প। আম্মা চা নিয়ে আসতেন তখন। একটা পিরিচে কয়েকটা বিস্কুটও থাকত। সেই বিস্কুট চা তে চুবিয়ে চুবিয়ে খেতাম। তৃপ্তিসহকারে বিকেলের নাস্তাটা শেষ হতো আমাদের। তারপর আবার শুরু হতো গল্প, টিপু সুলতানের গল্প! আম্মা পাশেই বসে থাকতেন, মিটিমিটি হাসতেন। আব্বার সহজ সরল পাগলামীর জন্য হয়ত, কিংবা আমার কাঁচমাচু হয়ে যাওয়া মুখটার জন্য। মাঝে মাঝে আজগুবি সব প্রশ্ন করতাম। আব্বা অপ্রস্তুত হয়ে যেতেন, উত্তর দিতে পারতেন না। শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন আমার, আর খুব গর্ব করে আম্মাকে বলতেন, "রেণু, এই ছেলে একদিন অনেক বড় কিছু হবে, তুমি দেখে নিও।" আম্মা অবশ্য কিছুই দেখে যেতে পারলেন না, তার আগেই চলে গেলেন।

একটা বিশাল শূন্যতাকে সাথে নিয়ে আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলাম। স্কুল থেকে যখন ঘরে ফিরি, তখন আর কেউ ভেতর থেকে দরজাটা খুলে দেয় না। বিশাল একটা তালা ঝোলানো থাকে সেখানে। পকেট থেকে চাবি বের করে সেই তালাটা খুলতে হয় প্রতিদিন। তারপর শূন্য ঘরের প্রতিটা রুমে পায়চারী করতে থাকি। ভুল করে মাঝে মাঝে আম্মার রুমেও চলে যাই। সবকিছু মনে পড়ে যায় তখন। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করি অনেক। ভালোই তো হল! কেউ তো আর বৃষ্টিতে ভিজতে বারণ করবে না। স্কুলের ড্রেসটা ঠিকমত গুছিয়ে রাখতে বলবে না। দেরি করে ঘরে ফিরলেও বকা দেবে না কেউ। আব্বার কাছে আর একটা নালিশও যাবে না আমার নামে। তবুও বোঝাতে পারি না নিজেকে। এই রক্ত মাংসের শরীরটার ভেতর "এমন কিছু" আছে যেটা বুঝতে চায় না। আর কেউ তো গরম এক কাপ চা বানিয়ে দেবে না, একটা পিরিচে দু-তিনটে বিস্কুট সাজিয়ে হাসিমুখে সামনে বসে থাকবে না। শার্টের একটা বোতাম খুলে গেলে কেউ আর এত যত্ন করে সেটা লাগিয়ে দেবে না। কিংবা অনেক রাতে যখন ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকব, তখন আর কেউ পাশে এসে বসবে না, মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে না। চোখের পাতা ঝাপসা হয়ে আসে আমার, সবকিছু কেমন জানি ঘোলাটে মনে হয়।

চোখের জলও শুকিয়ে যায় একদিন। কিভাবে জানি অনেক বড় হয়ে যাই। শৈশবের অনুভূতিগুলো একটা একটা করে উড়ে যেতে থাকে, বায়বীয় পদার্থের মতন। মাঝে মাঝে চোখ দুটো বন্ধ করে অনেক জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকি। শুধু যদি একটু গন্ধ পাওয়া যায়, একটু অনুভব করা যায়, সেই আশায়। কিন্তু গন্ধ পাই না কোন। দুর্বল হয়ে যাওয়া ঘ্রানশক্তিটা জানিয়ে দেয়, বড় হয়ে গেছি, অনেক বড়!

৩.

এক ঝড় বৃষ্টির রাতে আলো নিভিয়ে শুয়ে ছিলাম নিরিবিলি। খোলা জানলা দুটো দিয়ে কনকনে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছিল। আকাশে অনবরত মেঘের গর্জন আর বিদ্যুৎ চমকানি। এমন সময় হঠাৎ আব্বা এসে হাজির হলেন রুমে। আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করলেন। আর বারবার বলতে লাগলেন বাবলুকে এনে দিতে। এমন ঝড়বৃষ্টির রাতে বাবলুকে আনা সম্ভব ছিল না মোটেও। আব্বাকে বোঝালাম অনেক। কিন্তু কেমন জানি ছেলেমানুষী শুরু করলেন, বুঝতে চাইলেন না একদম। তারপর যখন ঝড়বৃষ্টি থেমে গেল, তখন কান্নাকাটি বন্ধ করলেন। চোখ মুছে ঘুমাতে গেলেন। আমি বুঝতে পারি সব। বাবলুটা নিশ্চয়ই এতদিনে অনেক বড় হয়ে গেছে। আজ যদি ও বাসায় থাকত, তাহলে হয়ত মেঘের গর্জন শুনে চিৎকার দিয়ে উঠত। জানলা দিয়ে হাত দুটো বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরতে চাইত। কিংবা আব্বার কোলে মাথাটা গুঁজে দিয়ে কোন একটা গল্প শুনতে চাইত, আর গল্পের মাঝখানেই ঘুমিয়ে পড়ত। আজকের রাতটা বাবলুর না থাকাটা মনে করিয়ে দিল আরেকবার।

ছোটখালার বাসায় গেলাম পরদিন। খালাকে খুলে বললাম সবকিছু। খালা একটা কথাও বললেন না, চুপচাপ শুনলেন শুধু। তারপর দু'টা দিন সময় চাইলেন। আর চোখের জল লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। কাঁদলেন। আমি কাউকে কিছু না বলে চলে আসলাম সেদিন। বুকের ভেতরটা কেমন জানি খালি খালি লাগছিল, কষ্ট হচ্ছিল খুব। কত বদলে গেছি আমি ! কত সহজে কষ্ট দিতে শিখে গেছি ! ধূলোমাখা শূন্য রাস্তাটা দিয়ে যখন ঘরে ফিরছিলাম,তখন আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল। খালা কোনদিন মা হতে পারবেন না। সৃষ্টিকর্তা তাকে সেই ক্ষমতা দেন নি। এতদিনে হয়ত বাবলুকে আপন করে নিয়েছেন অনেক। আর সেই মায়ার বন্ধন ছিন্ন করতে কেমন অযাচিতের মতন হাজির হলাম আমি !

বাবলুর ফিরে আসাটা আমাদের দু্ঃখ কষ্টের সংসারের জন্য অনেক বড় একটা ঘটনা ছিল। আব্বার বিষাদমাখা মুখটাতে হাসি ফুটল অনেকদিন পর। কতদিন পর নতুন একজন মানুষ আসলো আমাদের সংসারে ! প্রতি রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আব্বা টিপু সুলতানের গল্প শুনান তাকে। ঠিক ছয় বছর আগের মতন। এতটুকু ক্লান্তি নেই তার চোখে মুখে ! আমি দরজার বাইরে দাড়িয়ে চুপচাপ শুনতে থাকি সব, আড়চোখে দেখি মাঝে মাঝে। বাবলুটা আমার মত হয়নি একদম। বিরক্তিকর গল্প শুনতে তার খারাপ লাগে না একটুও। চোখমুখ শুকনো হয়ে যায় না। বরং দুই তিনবার করে শুনতে চায় একেকটা গল্প। আর গল্প শেষে দুই হাতের দুটো আঙুল মাথার উপর উঁচু করে ধরে। আব্বাকে জিজ্ঞেস করে, "বাবা, টিপু সুলতানের কি এইরকম শিং ছিল?"। আব্বা হতভম্ব হয়ে যান একদম। মুখ দিয়ে টু শব্দটাও বের হয় না। আমি দূর থেকে দেখি সব। কি অসাধারণ একটা মুহূর্ত ছিল ! শুধু যদি কোনভাবে ওই মুহূর্তটাকে ধরে রাখা যেত ! কিংবা সময়টাকে থামিয়ে দেয়া যেত কোনভাবে !

অবশ্য আমার মত তুচ্ছ মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছায় জগৎ সংসারের সময় থেমে থাকে না। সময় বরং চলে যায়, চোখের নিমিষে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ঢাকায় ভর্তির সুযোগ পেলাম। মফস্বল শহরের হাবাগোবা ছেলেটা ঢাকায় গিয়ে কই থাকবে, কি খাবে, এইসব হাবিজাবি চিন্তায় আব্বার ঘুম হলো না কয়েকদিন। আমি বুঝালাম অনেক। কাধেঁ হাত রেখে সাহস দিলাম, বললাম আমাকে নিয়ে চিন্তা না করতে। শেষমেষ কিছুটা শান্ত হলেন মনে হয়। আর আমি একবুক কষ্ট নিয়ে ব্যাগ গোছাতে লাগলাম। ঢাকায় আসার আগের রাতে বাবলু ঘুরঘুর করছিল আশেপাশে, আব্বাও নানা ছুতোয় দুই একটা অপ্রয়োজনীয় কথা বলে নিচ্ছিলেন। আমি ব্যাগ গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি। কিন্তু সেই রাতে আমার ঘুম হলো না একটুও। বারবার মনে পড়ছিল বাবলুর কথা, আব্বার কথা। বাবলু আমার পাশেই ঘুমিয়ে ছিল, খোলা জানলার দিকে মুখ করে। চাঁদের আলো এসে পড়ছিল ওর চোখে মুখে। ওর নিষ্পাপ মুখটার দিকে তাকিয়ে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল খুব, চোখের কোণে পানি জমল আরেকবার।

৪.

বড্ড বিচিত্র একটা জগৎ আবিষ্কার করলাম ঢাকায় এসে। নিরানন্দ আর নিষ্ঠুর একটা শহর। চারপাশের মানুষগুলোর ব্যাস্ততা সীমাহীন ! অন্য কাউকে নিয়ে ভাবার বিন্দুমাত্র সময় নেই তাদের। শুধু আমার কোন ব্যাস্ততা ছিল না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ক্লাসে চলে যেতাম। ফিরতাম একদম দুপুরে। বিকেলের সময়টা নিঃসঙ্গ কাটতো খুব। কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে তখন ক্যাফেটেরিয়ায় চলে যেতাম। একদম কোণার টেবিলটাতে গিয়ে বসতাম, যেখানে আর কেউ বসত না। তারপর গরম এককাপ চা আর ডালপুরীর অর্ডার দিতাম। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা থেকে বিভূতিভূষনের "অপরাজিত" বইটা বের করতাম। দুই একটা পাতা উল্টে পাল্টেও দেখতাম মাঝে মাঝে। কোন কোনদিন আবার হাঁটতে বের হতাম। শহীদ মিনার, টিএসসি, রমনা পার্ক কিংবা সোরওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম। চারপাশের সুখী মানুষগুলোকে দেখে হিংসা হত ভীষণ। খুব সম্ভবত তাদের কারো জীবনে এতটুকু অপূর্ণতাও ছিল না!

তবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা আমার নিজেরও খারাপ কাটেনি একেবারে। মাঝে মাঝে শুধু বাসার কথা মনে পড়ত। বাকি সময়টা ভালোই ছিলাম। সেকেন্ড ইয়ারে উঠে শায়লা নামের একটা মেয়েকে ভালো লেগে যায় ভীষণ। আমাদের সাথেই পড়ত। একটা প্রজেক্টে কাজ করার সময় একি গ্রুপে ছিলাম আমরা। সেই সূত্রে পরিচয়। কিন্তু ভালো লাগার কথাটা তাকে বলার মতন সাহস আমার ছিল না। আমি তাই নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলাম। বুকে পাথর বাঁধলাম। তাতে অবশ্য খুব একটা লাভ হলো না। ভালো লাগাটা বরং বাড়তে লাগল দিন দিন। আর আমি নিজের ভেতরে স্বপ্নের জাল বুনতে লাগলাম, একটু একটু করে। কোন এক বিকেলে হয়ত শাহবাগের মোড় থেকে লাল টকটকে গোলাপ কিনব কয়েকটা। তারপর খুব উদাস মুখ করে ভালো লাগার কথাটা বলব শায়লাকে। শায়লার ভীষণ অভিমান হবে তখন। ভালো লাগার কথাটা তাকে আগে বললাম না কেন, সেইজন্যে ! তারপর একদিন বিয়ে হবে আমাদের, আর থাকবে ঘরভর্তি বাচ্চা-কাচ্চা !

আমার কল্পনার রাজ্যে ডালপালা গজাতে থাকে দ্রুত। স্বপ্নগুলো বাড়তে থাকে দিন দিন। কিন্তু একদিন সবকিছু ভেঙেও যায় আবার। চৈত্রের এক বিকেলের ঘটনা। সারাদিনের কাজ শেষে শায়লা হাসি হাসি মুখ করে বলল, "দোস্ত, কাল একটু সকাল সকাল আসিস্‌, অনেক কাজ বাকি এখনো"। আমার ভেতরটা ভেঙেচুরে খান খান হয়ে যায় তখনি। এই "দোস্ত" শব্দটা শুনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। অনেক কষ্টে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, "ঠিক আছে"। কিন্তু ততক্ষনে আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরন শুরু হয়ে গেছে। আর আমার এতদিনকার যত স্বপ্ন, সব শেষ হয়ে গেছে নিমিষে!

আমি খুব আশাবাদী মানুষ ছিলাম। ছোট্ট এই জীবনটার উপর দিয়ে কত ঝড় বয়ে গেছে ততদিনে ! কিন্তু হতাশ হইনি কখনো। এবারও তাই হাল ছাড়লাম না। শায়লার আশেপাশেই ঘুরঘুর করতে লাগলাম। ক্যাফেটেরিয়ায় বসে গল্প করতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। আর পড়ন্ত বিকেলে একসাথে হাটতাম ক্যাম্পাসের ভেতর। আমিই বকবক করতাম বেশির ভাগ সময়। শায়লা চুপ করে থাকত, কি যেন ভাবত সবসময় ! আমাদের দুইটা বছর এভাবেই কেটে গেল। তখনও আমাদের সম্পর্কটা ছিল শুধুই "বন্ধুত্বের"। কিন্তু আমি আর পারছিলাম না। এক প্রচন্ড বৃষ্টির দিনে, শেষ বিকেলে যখন চারপাশটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল একদম, আমি আমার মনের কথাটা বলে ফেললাম শায়লাকে। শায়লার মুখটা মেঘে ঢেকে গেল মূহুর্তে ! চোখ দুটো নামিয়ে নিল সে। আর জানিয়ে দিল এ হবার নয়। নিজের উপর করুনা হল ভীষণ। আমার ভাগ্যটাই আসলে খারাপ। কাউকে ধরে রাখার মতন ক্ষমতা দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয় নি আমাকে!

পাশ করার পর সবকিছুর প্রতি কেমন জানি একটা বিতৃষ্না জন্মাল। অসহ্য মনে হতে লাগল সবকিছু। বন্ধুবান্ধবদের একটা বড় অংশ দেশের বাইরে যাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। আর আমিও সব পিছুটান অগ্রাহ্য করে দেশ ছাড়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলাম। একাডেমিক রেজাল্ট ভালোই ছিল আমার। একটা স্কলারশীপ ম্যানেজ করতে খুব বেশি কষ্ট হল না তাই। আস্তে আস্তে সব গুছিয়ে নিলাম। একদিন সব ছেড়ে চলে যাবার জন্য এয়ারপোর্টে গিয়ে হাজির হলাম। বাবলু সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল অঝোরে। আব্বার চোখ দুটোও টলমল করছিল পানিতে। আর আমার বুকের ভেতরে কোথায় জানি তীব্র ব্যাথা হচ্ছিল। কিন্তু ততদিনে আমার জানা হয়ে গেছে, "পিছুটান" আমাকে কষ্ট দিবে শুধু। আমি তাই সব পিছুটান অস্বীকার করে প্লেনে চেপে বসলাম। একবুক কষ্ট নিয়ে দেশ ছাড়লাম !

৫.

গরম এক মগ কফি বানিয়ে জানলার পাশে গিয়ে বসলাম। আমার অ্যাপার্টম্যান্টের জানলা থেকে বাইরের তুষারপাতের দৃশ্যটা দেখতে অসাধারন লাগে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি আমি। মনটা খারাপ হয়ে যায় তখন। এরকম একটা মুহুর্তে আমার আজ একা থাকার কথা ছিল না। অন্তত কেউ একজন পাশে থাকার কথা ছিল, যার হাত দুটো মুঠোয় পুরে বুকের ভেতরের জমানো কষ্টগুলোর কথা বলতে পারতাম ! কিংবা যার দীঘল কালো চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে সব কষ্ট ভুলে থাকতে পারতাম মুহুর্তের জন্য ! আমার জীবনটা এমন হয়ে গেল কেন কে জানে ! গত সাত বছরে একটাবারের জন্যও দেশে যাওয়া হয় নি। আব্বা যেদিন মারা যান, সেদিন সব গুছিয়ে নিয়েছিলাম, দেশে যাবার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয় নি। আব্বার হাসিখুশি আর জীবন্ত মুখটাই স্মৃতিতে থাকুক! হতভম্ব আর অপ্রস্তুত হয়ে যাওয়া মুখটাই মনে থাকুক সারাজীবন ! আমার আদরের ছোট্ট ভাইটা কেমন আছে তাও জানিনা ! ওর সাথে কথা হয় না আজ অনেক দিন। ইদানীং খুব দেখতে ইচ্ছে করে ওকে, এতদিনে নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে। শায়লার কথাও মনে পড়ে মাঝে মাঝে। ঘরভর্তি বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে নিশ্চয়ই অনেক সুখে আছে ও। আর সবচাইতে বেশি মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা, যখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামত। আর আমি জানলা দুটো খুলে দিতাম। হু হু করে ঠান্ডা বাতাস ঢুকত সেখান দিয়ে। আম্মা বকা দিতেন ভীষণ। কিন্তু আমি শুনতাম না একটুও। বুক ফেটে কান্না আসে আমার। টেবিলের উপর মাথাটা রেখে কাঁদতে থাকি অঝোরে। কিন্তু এই পাষাণহৃদয় মানুষটার কান্না দেখার মতন সৌভাগ্য কারো হয় না !   


-এবিএম
 ০৬/০৪/২০১২

চক্র

বিকেলের ঘুমটা হঠাৎ করেই ভেঙে যায় মিলির। চোখদুটো মেলে চারপাশটা দেখতে থাকে সে। কোথায় আছে বুঝতে কিছুটা সময় লাগে তার।  
এত সুন্দর একটা স্বপ্নের মাঝখানে ঘুমটা ভেঙে গেল!
একটু আগেও তার পাশে একজন মানুষ ছিল।
বৃষ্টিভেজা একটা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল তারা দুজন।
নির্জন,নিস্তব্ধ আর অনন্ত বিস্তৃত সেই রাস্তাটার কোন শেষ ছিল না।
অথচ এতটুকু ক্লান্তিও ছিল না কোথাও।
মিলির মনটা খারাপ হয়ে যায় ভীষন। বিকেলের স্বপ্নগুলো যদি সত্যি হত!
ভেতরের রুম থেকে শোরগোলের শব্দ শুনতে পায় সে। আস্তে আস্তে বিছানার উপর উঠে বসে। এলোমেলো চুলগুলো বেধে নেয় খুব যত্ন করে। মিলিকে উঠতে দেখে টুনি দৌড়ে আসে ভেতর থেকে।
"আপা তোর বিয়ে হয়ে যাবে"- টুনির মুখটা শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেছে।
"তোকে কে বলল এসব?"
"আমি সব জানি আপা,তোর বিয়ে হয়ে যাবে"।
মিলির বিশ্বাস হয় না একদম। আবার অবিশ্বাসও করতে পারে না। এইরকম বয়সে তার বড় আপারও বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, বাবার এক বন্ধুর ছেলের সাথে। বাবা বেশ কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন তার কাছ থেকে। কিন্তু সেই টাকা দেয়ার মতন সামর্থ্য বাবার ছিল না। আপাকে একরকম জোর করেই বিয়ে দেয়া হয়েছিল। আপাও টু শব্দটি করে নি। মুখ বুঝে মেনে নিয়েছিল সবকিছু।
"আমি না থাকলে তোর কি অনেক কষ্ট হবে?"-মিলি জিজ্ঞেস করে।
টুনি এই প্রশ্নের কোন উত্তর দেয় না। চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে কিছুক্ষন। তারপর মুখটা নিচু করে চলে যায়। মিলি অবাক হয় ভীষন। এতটুকু একটা মেয়ে। মায়া,মমতা আর ভালবাসার মত জটিল বিষয়গুলো যার বুঝার কথা না, সেও কত সহজে মায়ার জালে বন্দী হয়ে গেছে! কত সহজে মান অভিমান করা শিখতে শুরু করেছে!
একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে আপনাআপনি।
মায়া বড় কঠিন জিনিস, অস্বীকার করা যায় না তাকে।
আকাশ দেখা হয় না আজ অনেকদিন। বারান্দায় দাড়িয়ে শরতের আকাশটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মিলি। অসাধারন একটা অনুভূতি হয় তার। অল্প কিছু মুহুর্তের জন্য বেঁচে থাকাটা সার্থক মনে হয়, জীবনটাকে আর অর্থহীন মনে হয় না।
বাসার সামনের রাস্তাটার দিকে চোখ পড়তেই মনির ভাইকে দেখতে পায় মিলি। মনির ভাই হা করে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিলেন। হন্তদন্ত করে সামনের দিকে যাওয়া শুরু করলেন। কিছুদূর গিয়েই আবার ফেরত আসলেন।
-"এই দিক দিয়েই যাচ্ছিলাম মিলি,কেমন আছ?"
মিলির হাসি পায় ভীষন। প্রতিদিন এই রাস্তাটায় দাড়িয়ে থাকেন মনির ভাই। দেখা হলে প্রতিদিন একই কথা বলেন। তারপর খুব ব্যস্ত ভঙিতে চলে যান সামনের দিকে।
"জ্বি মনির ভাই, ভালো আছি"- মিলি উত্তর দেয়।
হাতের ঘড়িটার দিকে বারবার তাকাতে থাকেন মনির ভাই। কয়েকবার আকাশের দিকেও তাকান। বৃষ্টি আসবে কিনা সেটা পরখ করে নিচ্ছন যেন।
"আজ যাই মিলি, অন্য একদিন কথা হবে"।
কথাটা বলেই আর দাড়ান না মনির ভাই, খুব ব্যস্ত ভঙিতে চলে যান সামনের দিকে। মানুষটা আসলেই ভীষন বোকা। দিনের পর দিন এভাবে দাড়িয়ে থাকেন কেন কে জানে?
মা পাশে এসে দাড়িয়েছেন অনেক্ষন হলো।
"মিলি,কাল বাসায় কিছু মেহমান আসবে,একটু সেজেগুজে থাকিস মা"।
এই প্রথম অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠে মিলির। চোখের কোনে পানি জমতে শুরু করে। বাবা আবার কি করে বসেছেন কে জানে? মা বুঝতে পারেন সব। সাহস জোগানোর চেষ্টা করেন শুধু।
"ছেলেটা অনেক ভালো, তুই অনেক ভালো থাকবি মা"।
মা'র চোখদুটোও ছলছল করে উঠে পানিতে। আর কিছু বুঝতে বাকি থাকে না মিলির। বড় আপার পর এবার তাকেও বলির পাঠা বানানো হচ্ছে। দু'চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না সে। মায়ের সামনে থেকে চলে যায়। বাথরুমের দরজাটা লাগিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে।
রাতে টুনিকে নিয়ে ছাদে উঠে মিলি।
বাগানটা ঠিক আগের মতই আছে।
গোলাপগুলোর রংও বদলায়নি এতটুকু।
কিংবা আকাশের পূর্নিমার চাঁদের আলো, সেটাও ম্লান হয় নি একরত্তি।
শুধু চারপাশটা অদ্ভুত রকমের নির্জন,নির্জীব। কোথাও প্রানের ছোঁয়া নেই।
আপার কথা মনে পড়ে মিলির।
একসময় আপার সাথে এই ছাদে উঠতো। ছাদের এপাশ থেকে ওপাশ চষে বেড়াতো দু'জন। সারারাত গল্পের আসর বসাতো। সবচেয়ে বেশি মজা হতো ভূতের গল্পগুলোর দিন, রাতে আর ঘুমাতে পারত না মিলি, আপাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতো শুধু।
সেই আপাকে গত পাঁচ বছরে একবারের জন্যও দেখল না মিলি। একটাবারের জন্যও কথা হল না তার সাথে। তার দুঃখিনী আপাটা কোথায় আছে, কেমন আছে, কিচ্ছু জানে না মিলি।
আপার বিয়ের দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে মিলির।
বিয়ের আগের দিন সারাটা রাত কেঁদেছিল আপা।
কিন্তু কি আশ্চর্য্য, বিয়ের দিন তার দু'চোখে এক ফোটা অশ্রুও ছিল না। বুকে পাথর বেধে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল আপা। নিজের কষ্টগুলোর কথা কাউকে বুঝতে দেয় নি, মুখ ফুটে কাউকে বলেওনি কোনদিন। অথচ সৃষ্টিকর্তার কি প্রহসন,ভদ্রগোছের একটা লম্পটকে গছিয়ে দিলেন তিনি।
টুনিটা চুপচাপ বসে আছে, হাঁসিখুশি মেয়েটা হঠাৎ করেই নিশ্চুপ হয়ে গেছে। কি ভাবছে কে জানে?
হয়ত নিজের কথাই ভাবছে।
একদিন তো সেও বড় হবে।
স্বপ্ন দেখা শুরু করবে।
তারপর সেই স্বপ্নগুলিকে জলান্জলি দিয়ে মুখ বুঝে সব সহ্য করে নেবে।
পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ শুধু প্রতারিত হতে আসে, তাদের স্বপ্ন দেখতে হয় না।
পরদিন সকাল থেকেই মিলিদের বাড়িভর্তি মানুষ। মিলিকে পছন্দ হলো তাদের। খুব দামী একটা আংটি পরানো হল, আর খুব কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হল। আজ রাতেই মিলিকে নিয়ে যাবে তারা। ছেলে দেশের বাইরে থাকে। খুব বেশিদিন দেশে থাকবে না,এই জন্যই এত তাড়াহুড়ো।
বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যায় মিলির।
এতদিনের পরিচিত ঘর,পরিচিত মানুষজন, সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে। টুনিটার জন্য অনেক খারাপ লাগবে তার। মেয়েটা বড্ড একা হয়ে গেল।
সন্ধ্যার পর প্রচন্ড বৃষ্টি নামে।
শেষবারের মতন বৃষ্টিটাকে আপন করে দেখতে ইচ্ছে হয় তার। বারান্দায় গিয়ে দাড়ায় মিলি। খুব অপ্রত্যাশিত ভাবে মনির ভাইকে দেখতে পায় রাস্তায়। বৃষ্টিতে ভিজছেন মনির ভাই। মিলির চোখে চোখ পড়তেই চোখদু'টো নামিয়ে নিলেন। কিন্তু আজ আর চলে গেলেন না। অপরাধীর মতন দাড়িয়ে রইলেন শুধু।
জীবনে এই প্রথমবারের মত কোন মানুষকে ভালোবাসতে ইচ্ছে হয় মিলির,ভীষন ইচ্ছে হয়। বোকা এই মানুষটা তাকে একটাবার দেখার জন্য এই বৃষ্টির মধ্যে দাড়িয়ে আছে, কতক্ষন দাড়িয়ে আছে কে জানে? মিলির খুব বলতে ইচ্ছে করে,"আপনি এভাবে বৃষ্টিতে ভিজবেন না,জ্বর হবে তো"।
কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
কথাটা হয়ত আর কোনদিন বলা হবে না।
নিজের রুমে এসে চুপচাপ শুয়ে থাকে মিলি।
আচ্ছা,ওই স্বপ্নটা যদি আরেকবার দেখা যেত!!
বৃষ্টিভেজা আর দিগন্তবিস্তৃত একটা রাস্তা।
দু'পাশে কোন মানুষজন নেই তার।
শুধু একজন অপরিচিত মানুষের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছ মিলি।
মুহুর্তে চমকে উঠে মিলি।
সেই অপরিচিত মানুষটা আর কেউ না-মনির ভাই।
মিলি বুঝতে পারে, বিকেলের স্বপ্নগুলো সত্যি হয় না।


চৈত্র

চৈত্র মাসে খুব একটা বৃষ্টি হয় না এখানে। তারপরও কোথা থেকে জানি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। সেই বৃষ্টি আর থামতে চায় না।
রাশেদ ছাদেই দাঁড়িয়ে ছিল। চৈত্রের এই অপ্রত্যাশিত বৃষ্টি তার সারাটা শরীর ভিজিয়ে দিল।
পকেট থেকে খুব সস্তা দামের একটা সিগারেট বের করে ধরাল সে।
দামী সিগারেট কেনার মতো সামর্থ্য তার নেই।
আয়েশী ভঙ্গিতে সেই সিগারেটটা টানতে থাকে রাশেদ।
চারপাশে পূর্ণিমার চাঁদের আলো, বৃষ্টিটাও কিছুটা কমে গেছে এখন। টিপ টিপ বৃষ্টিতে একটা দুঃখী মানুষ সিগারেট টানছে, কিছুক্ষন পর পর আকাশের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে, বুকের ভেতরের সবটুকু কষ্টকে বের করে দিতে চাইছে যেন! অসাধারন একটা দৃশ্য, তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় শুধু।
দূর থেকে চুপচাপ সবকিছুই দেখছিলো বীথি। দাদাকে অসাধারন লাগছিল তার।
অন্য সময় হলে দাদাকে সিগারেট খেতে নিষেধ করতো, কিংবা বাবার কাছে নালিশ দেয়ার ভয় দেখাতো।
কিন্তু আজ ভিন্ন ব্যাপার।
কাল সকালেই দেশের বাইরে চলে যাবে দাদা। অভাবের এই সংসারটার ঘানি টানার আর কেউ নেই। বাবা অনেক দিন ধরেই অসুস্থ, মন্টুটাও সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। যা করার দাদাকেই করতে হবে।
বীথির মনটা খারাপ হয়ে যায় ভীষন, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে।
আর কেউ তাকে কানি বুড়ি বলে ক্ষেপাবে না, দামী চকলেট কিংবা আইসক্রিম কিনে দেবে না, অদ্ভুত রকমের জন্মদিনগুলোতে কেউ আর দামী বইও উপহার দেবে না তাকে।
সৃষ্টিকর্তার উপর ভীষণ অভিমান হয় তার, প্রিয় মানুষগুলোকে তিনি কত সহজে দূরে সরিয়ে দেন! দাদার সাথে আবার কবে দেখা হবে কে জানে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মেয়েটা।
"দাদা, চা খাবি?"- বীথি জিজ্ঞেস করে।
হাতের সিগারেটটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে রাশেদের, বীথিকে চা নিয়ে আসতে বলে সে।  
ছাদের রেলিং এ ঝুঁকে চারপাশটা দেখতে থাকে রাশেদ।
ভাবতে ভীষন অবাক লাগে তার, মফস্বল শহরের রং উঠে যাওয়া পুরনো এই বাড়িটাতে কখন যে পনেরটা বছর কেটে গেল!  
প-নে-র-টা বছর!! ভাবা যায়? কত স্মৃতি ছড়ানো তাতে, কত রং বেরংয়ের একেকটা দিন। বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠে তার।
রাস্তার শেষ মাথার চায়ের দোকানটার দিকে তাকায় রাশেদ।
বিদ্যুত নেই।
হ্যাজাক লাইটের আলোয় চায়ের গ্লাস হাতে জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছে কয়েকজন।
নাজমুল,ইশতিয়াক আর অনিমেষরাও হয়ত আছে।
শুধু রাশেদ নেই। মনটা খারাপ হয়ে যায় তার।
ভাঙ্গা টেবিলটাতে বসে হয়ত আর আড্ডা দেয়া হবে না।
চায়ের গ্লাস হাতে রাতের পর রাত নির্ঘূম কাটবে না।
বুকের ভেতরের জমানো কষ্টগুলোর কথাও হয়ত আর কাউকে বলা হবে না।
অনিমেষদের কথা অনেক মনে পড়বে রাশেদের।
বীথি চা দিয়ে যায়।
সারাদিন মেয়েটা অনেক কেঁদেছে, দেখলে বোঝা যায়। রাশেদের খারাপ লাগে। তার মত একটা বদ্দ উন্মাদকে সবাই এত আপন ভাবে কেন কে জানে!!
বাবার কথা মনে পড়ে রাশেদের।
মানুষটাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না তার।
সারাটাজীবন শুধু কষ্টই করে গেলেন, বিনিময়ে তেমন কিছুই পেলেন না।
ইদানীং বাবাকে দেখলে ভীষন মায়া হয় তার, কেমন জানি বিপর্যস্ত আর পরাজিত মনে হয়।
বাবার ক্লান্ত-শ্রান্ত মুখটার ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে বারবার।
এই অসহায় মানুষটাকে দেখার মত আর কেউ রইল না।
চা টা শেষ করে আনমনে পায়চারী করতে থাকে রাশেদ।
রাত প্রায় এগারটার মতন বাজে।
টিপটিপ বৃষ্টিটা এখনো থামে নি, চারপাশটা বেশ নির্জন হয়ে গেছে।
এরমধ্যেই কোথা থেকে জানি মন্টুটা এসে হাজির হয়।
"দাদা, তুই কি কাল সকালেই চলে যাচ্ছিস?"
"হুম্‌ম্‌"- রাশেদ উত্তর দেয়।
মন্টু সিগারেট ধরায়। এ কাজটা সে আগেও অনেকবার করেছে। দাদাকে খুব বেশি ভয় পায় না সে। রাশেদও অবশ্য তেমন কিছু বলে না তাকে।
দুজনেই চুপচাপ বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে।
মন্টুর দিকে তাকায় রাশেদ।
আহারে, একটা বাইক কেনার কত সাধ ছিল ছেলেটার, টাকার অভাবে সেটা আর কিনে দেওয়া হয়নি।
নিজের কথা ভাবে রাশেদ, একসময় তারও অনেক স্বপ্ন ছিল, সেইসব স্বপ্ন আর পূরণ হয় নি। কোনদিন পূরণ হবে বলেও মনে হয় না। বুকের ভেতরটা বেশ ভারী হয়ে উঠে তার।
রাত অনেক হয়ে গেছে।
মা নীরবে ছাদের দরজার কাছে এসে দাঁড়ান, আঁচল দিয়ে চোখের জল মোছেন, একবার শুধু বলেন, "ঘুমাতে আয়"।
রাশেদের চোখদুটো ছলছল করে উঠে।
এত আদর করে কেউ আর ঘুমাতে বলবে না।
বৃষ্টিতে ভিজতে বারণ করবে না।
পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে না কেউ।
কতদিন পর দেশে ফিরবে রাশেদ?
পাঁচ বছর? দশ বছর?..... কিংবা আরো বেশি সময়ও লাগতে পারে!!
পাগলীটার (বীথির) হয়ত ততদিনে বিয়ে হয়ে যাবে, পরের ঘরে চলে যাবে সে। বিয়ের পর তো সবাই দূরে সরে যায়, সে ও হয়ত আর এতো আপন থাকবে না!
মন্টুটাও নিশ্চয়ই এমন থাকবে না, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে অনেক।
বাবার সাথে আর দেখা হবে কিনা কে জানে, বাবার শরীরের অবস্থটা খুব বেশি ভালো না, যেকোনো সময় একটা কিছু ঘটে যেতে পারে।
অনিমেষরা হয়ত তার কথা ভুলেই যাবে। কত নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হবে তাদের, তার মতো তুচ্ছ মানুষকে মনে রাখার কি দরকার?
আজ থেকে অনেক বছর পর চৈত্রের কোন এক রাতে হয়ত আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে।
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে।
রং উঠে যাওয়া পুরনো এই বাড়িটার ছাদে রাশেদ হয়ত আবার বৃষ্টিতে ভিজে যাবে, টিপটিপ বৃষ্টিতে সিগারেট ধরাবে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়বে।
কিন্তু সেদিন তার পাশে কেউ থাকবে না।
এই পৃথিবীতে মানুষ আসলে বড্ড একা, আপনজন বলতে তার কেউ নেই।
বৃ্ষ্টিটা হঠাৎ করেই বাড়তে থাকে।
দু'হাতে মুখ ঢেকে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে রাশেদ।
তার দু'চোখের জল আর চৈত্রের অপ্রত্যাশিত বৃষ্টির জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।