মোট পৃষ্ঠাদর্শন

শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৩

যখন বৃষ্টি নামত

১.

বাবলুর জন্মের সময় আম্মা মারা যান।

তার আগে আমাদের ছোট্ট একটা সংসার ছিল। আব্বা, আম্মা আর আমি। ভাঙাচোরা একটা বাসা ছিল আমাদের। সেই বাসার দেয়াল আর ছাদ থেকে চুনকাম খসে পড়ত নিয়মিত। জানলার গ্রিলে হাত রেখে দাড়ালে হাত দুটো রাঙা হয়ে যেত। শেওলাধরা কার্নিশের দিকে চোখ পড়লে গা-টা ঘুলিয়ে উঠত। সবচাইতে অদ্ভুত ছিল ঘরের মেঝেটা, কালের বিবর্তনে কিভাবে জানি কতগুলো খানাখন্দ তৈরী হয়েছিল সেখানে। অন্দরমহলের অবস্থাটা ছিল আরো করুণ। একটু এপাশ ওপাশ হলেই বিছানাটা বিচ্ছিরিভাবে আর্তনাদ করে উঠত। ঘুঁণেধরা পড়ার টেবিলটা কাঁপত অনবরত। সামনের বসার রুমটাও সাজানো ছিল হাস্যকরভাবে। যার অন্যতম আকর্ষণ ছিল লাল স্কচটেপ দিয়ে দেয়ালে ঝোলানো একজোড়া চিত্রা হরিণ।

তারপরও সুখে ছিলাম। আব্বা ছোট্ট একটা সরকারী চাকরী করতেন। অল্প কিছু টাকা মাইনে পেতেন। তার পুরোটাই খরচ করতেন আমাদের জন্য। আম্মা সংসারের জন্য অনেক খাটতেন, অসাধারণ ছিল তার রান্নার হাত। প্রতি শুক্রবার পোলাও মাংস রান্না হতো আমাদের বাসায়। একসাথে খেতে বসতাম আমরা। আব্বা হয়ত সেখানে তার অফিসের মিজান সাহেবের গল্পটা বলতেন। আর আম্মা সত্য মিথ্যা মিলিয়ে নানা অভিযোগ করতেন আমার নামে। আমি কিছু বলতাম না, চুপচাপ শুনতাম শুধু। তারপর কথা দিতাম, আর কোনদিন এমনটা হবে না। আর কোনদিন নিয়ম ভাঙবো না, কথার অবাধ্য হব না একরত্তি। কিন্তু সেইসব কথা আর রাখা হতো না, নিয়ম ভাঙতাম নিয়মিত। একেকদিন একেকটা অঘটন ঘটাতাম, আর আমার ছোট্ট মনোজগতটা নেচে উঠত এক অপরিসীম আনন্দে। এতকিছুর পরেও মাঝে মাঝে ভীষণ একা হয়ে যেতাম। সবকিছু কেমন জানি অর্থহীন মনে হতো, শূন্য মনে হতো। অতটুকুন বয়সে এমন দুর্বোধ্য অনুভূতিগুলো কোথা থেকে আসত কে জানে!

আমার একাকীত্ব ঘোচানোর জন্য আব্বা আম্মার চেষ্টার কোন কমতি ছিল না। আব্বা অনেক দামী দামী বই উপহার দিতেন। প্রথম কয়েকদিন সেগুলো পড়তাম না, গন্ধ শুঁকতাম শুধু। তারপর এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করতাম একের পর এক। আমার একাকীত্ব তবু ঘুঁচত না। মন খারাপ করে তাকিয়ে থাকতাম দূরের আকাশটার দিকে। বিকেলের শেষ দিকে ভেন্টিলেটরে বাসা বাঁধা চড়ুইগুলোর ঘরে ফেরা দেখতাম। সন্ধ্যার পর মাঝে মাঝে যখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামত, তখন আম্মার শত বারণ সত্বেও জানলা দুটো খুলে দিতাম। হু হু করে ঠান্ডা বাতাস ঢুকত সেখান দিয়ে। গভীর রাতে হয়ত ঝড় বৃষ্টি থেমে যেত, তখন আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠতাম। জানলার গ্রিল ধরে নিঃশব্দে দাড়িয়ে থাকতাম। পরিষ্কার আকাশে একফালি চাঁদ উঠত তখন। অপলক চোখে তাকিয়ে থাকতাম আমি। মন খারাপ করা চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আমার ভেতরটা শূন্য হয়ে যেত, অকারনে পানি জমত চোখের কোনায়।

একদিন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। আমাদের ছোট্ট সুখের সংসারটা স্তব্ধ হয়ে গেল একদম। কাউকে কিছু না বলে আম্মা চলে গেলেন, আর কোনদিন ফিরলেন না। এত অভিমান হল আম্মার উপর! দুঃখ-কষ্টের পৃথিবীটা ছেড়ে কেমন স্বার্থপরের মতন চলে গেলেন, একটাবারের জন্যও আমাদের কথা ভাবলেন না। আমার কথা, আব্বার কথা, বাবলুর কথা।

বাবলুর দিকে তাকিয়ে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল ভীষণ, নিষ্পাপ মুখটাতে কি অসম্ভব মায়া ছড়ানো! একটা দেবশিশু যেন স্বর্গ থেকে ভুল করে এখানে এসে পড়েছে, হাসপাতালের এই জরাজীর্ণ বিছানায়। এই দেবশিশুটাই একদিন অনেক বড় হবে, আস্তে আস্তে বুঝতে শিখবে সবকিছু। কিন্তু "মা" কি জিনিস সেটা হয়ত আর কোনদিন বুঝবে না। "মাতৃস্নেহ" কি জিনিস সেটা হয়ত আর কোনদিন জানবে না। কয়েকটা দিন আগের ছবিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে আমার। বাবলুকে একটাবার দেখার জন্য কি অপরিসীম অপেক্ষা ছিল আম্মার, কতকিছু বানিয়ে রেখেছিলেন যত্ন করে। আর কতরাত যে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন, সেটাও বা কে জানে? শুধু বাবলু যদি একটাবার জানত! শুধু একটাবার জানত সে যখনও পৃথিবীতে আসে নি তখনও আম্মা তাকে কতটা ভালোবাসতন। বাবলুর আর কোনদিনি জানা হবে না এসব। আম্মার মৃত্যুসংবাদে আমার হাউমাউ করে কান্নাকাটি করার কথা ছিল, কিন্তু আমি সেটা করলাম না। আব্বাকে জড়িয়ে ধরে কয়েক ফোঁটা চোখের জল বিসর্জন দিলাম শুধু। আর জীবনে প্রথমবারের মত আব্বাকে কাঁদতে দেখলাম। আব্বা শিশুর মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন, এত কষ্ট হচ্ছিল আমার!

বাবলুকে দেখার মত আর কেউ অবশিষ্ট থাকল না আমাদের সংসার এ। ছোটখালাকে খবর দেয়া হল। খালা হাসপাতাল থেকে নিয়ে গেলেন বাবলুকে। আর আমি আব্বাকে নিয়ে ঘরে ফিরলাম, একদম নিঃশব্দে।

২.

আম্মা মারা যাবার পর আব্বা বদলে গেলেন, কেমন জানি হয়ে গেলেন দিনে দিনে। আগের মত আর কথা বলেন না, প্রান খুলে হাসেন না। অথচ একটা সময় ছিল যখন অফিস থেকে ফিরেই অস্থির হয়ে যেতেন খুব, অকারনে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করতেন। আম্মাকে ঢেকে বলতেন, "রেণু, গরম এক কাপ চা বানিয়ে দাও তো"। তারপর আমাকে জাগিয়ে তুলতেন ঘুম থেকে। অপরিসীম আগ্রহ নিয়ে শুরু করতেন টিপু সুলতান কিংবা নবাব সিরাজউদ্দৌলার গল্প! আমার ভালো লাগত না মোটেও। এই দুটো ছাড়া আর কোন গল্প জানতেন না আব্বা। চুপচাপ বসে শুনতাম একেকটা গল্প। আম্মা চা নিয়ে আসতেন তখন। একটা পিরিচে কয়েকটা বিস্কুটও থাকত। সেই বিস্কুট চা তে চুবিয়ে চুবিয়ে খেতাম। তৃপ্তিসহকারে বিকেলের নাস্তাটা শেষ হতো আমাদের। তারপর আবার শুরু হতো গল্প, টিপু সুলতানের গল্প! আম্মা পাশেই বসে থাকতেন, মিটিমিটি হাসতেন। আব্বার সহজ সরল পাগলামীর জন্য হয়ত, কিংবা আমার কাঁচমাচু হয়ে যাওয়া মুখটার জন্য। মাঝে মাঝে আজগুবি সব প্রশ্ন করতাম। আব্বা অপ্রস্তুত হয়ে যেতেন, উত্তর দিতে পারতেন না। শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন আমার, আর খুব গর্ব করে আম্মাকে বলতেন, "রেণু, এই ছেলে একদিন অনেক বড় কিছু হবে, তুমি দেখে নিও।" আম্মা অবশ্য কিছুই দেখে যেতে পারলেন না, তার আগেই চলে গেলেন।

একটা বিশাল শূন্যতাকে সাথে নিয়ে আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলাম। স্কুল থেকে যখন ঘরে ফিরি, তখন আর কেউ ভেতর থেকে দরজাটা খুলে দেয় না। বিশাল একটা তালা ঝোলানো থাকে সেখানে। পকেট থেকে চাবি বের করে সেই তালাটা খুলতে হয় প্রতিদিন। তারপর শূন্য ঘরের প্রতিটা রুমে পায়চারী করতে থাকি। ভুল করে মাঝে মাঝে আম্মার রুমেও চলে যাই। সবকিছু মনে পড়ে যায় তখন। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করি অনেক। ভালোই তো হল! কেউ তো আর বৃষ্টিতে ভিজতে বারণ করবে না। স্কুলের ড্রেসটা ঠিকমত গুছিয়ে রাখতে বলবে না। দেরি করে ঘরে ফিরলেও বকা দেবে না কেউ। আব্বার কাছে আর একটা নালিশও যাবে না আমার নামে। তবুও বোঝাতে পারি না নিজেকে। এই রক্ত মাংসের শরীরটার ভেতর "এমন কিছু" আছে যেটা বুঝতে চায় না। আর কেউ তো গরম এক কাপ চা বানিয়ে দেবে না, একটা পিরিচে দু-তিনটে বিস্কুট সাজিয়ে হাসিমুখে সামনে বসে থাকবে না। শার্টের একটা বোতাম খুলে গেলে কেউ আর এত যত্ন করে সেটা লাগিয়ে দেবে না। কিংবা অনেক রাতে যখন ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকব, তখন আর কেউ পাশে এসে বসবে না, মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে না। চোখের পাতা ঝাপসা হয়ে আসে আমার, সবকিছু কেমন জানি ঘোলাটে মনে হয়।

চোখের জলও শুকিয়ে যায় একদিন। কিভাবে জানি অনেক বড় হয়ে যাই। শৈশবের অনুভূতিগুলো একটা একটা করে উড়ে যেতে থাকে, বায়বীয় পদার্থের মতন। মাঝে মাঝে চোখ দুটো বন্ধ করে অনেক জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকি। শুধু যদি একটু গন্ধ পাওয়া যায়, একটু অনুভব করা যায়, সেই আশায়। কিন্তু গন্ধ পাই না কোন। দুর্বল হয়ে যাওয়া ঘ্রানশক্তিটা জানিয়ে দেয়, বড় হয়ে গেছি, অনেক বড়!

৩.

এক ঝড় বৃষ্টির রাতে আলো নিভিয়ে শুয়ে ছিলাম নিরিবিলি। খোলা জানলা দুটো দিয়ে কনকনে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছিল। আকাশে অনবরত মেঘের গর্জন আর বিদ্যুৎ চমকানি। এমন সময় হঠাৎ আব্বা এসে হাজির হলেন রুমে। আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করলেন। আর বারবার বলতে লাগলেন বাবলুকে এনে দিতে। এমন ঝড়বৃষ্টির রাতে বাবলুকে আনা সম্ভব ছিল না মোটেও। আব্বাকে বোঝালাম অনেক। কিন্তু কেমন জানি ছেলেমানুষী শুরু করলেন, বুঝতে চাইলেন না একদম। তারপর যখন ঝড়বৃষ্টি থেমে গেল, তখন কান্নাকাটি বন্ধ করলেন। চোখ মুছে ঘুমাতে গেলেন। আমি বুঝতে পারি সব। বাবলুটা নিশ্চয়ই এতদিনে অনেক বড় হয়ে গেছে। আজ যদি ও বাসায় থাকত, তাহলে হয়ত মেঘের গর্জন শুনে চিৎকার দিয়ে উঠত। জানলা দিয়ে হাত দুটো বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরতে চাইত। কিংবা আব্বার কোলে মাথাটা গুঁজে দিয়ে কোন একটা গল্প শুনতে চাইত, আর গল্পের মাঝখানেই ঘুমিয়ে পড়ত। আজকের রাতটা বাবলুর না থাকাটা মনে করিয়ে দিল আরেকবার।

ছোটখালার বাসায় গেলাম পরদিন। খালাকে খুলে বললাম সবকিছু। খালা একটা কথাও বললেন না, চুপচাপ শুনলেন শুধু। তারপর দু'টা দিন সময় চাইলেন। আর চোখের জল লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। কাঁদলেন। আমি কাউকে কিছু না বলে চলে আসলাম সেদিন। বুকের ভেতরটা কেমন জানি খালি খালি লাগছিল, কষ্ট হচ্ছিল খুব। কত বদলে গেছি আমি ! কত সহজে কষ্ট দিতে শিখে গেছি ! ধূলোমাখা শূন্য রাস্তাটা দিয়ে যখন ঘরে ফিরছিলাম,তখন আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল। খালা কোনদিন মা হতে পারবেন না। সৃষ্টিকর্তা তাকে সেই ক্ষমতা দেন নি। এতদিনে হয়ত বাবলুকে আপন করে নিয়েছেন অনেক। আর সেই মায়ার বন্ধন ছিন্ন করতে কেমন অযাচিতের মতন হাজির হলাম আমি !

বাবলুর ফিরে আসাটা আমাদের দু্ঃখ কষ্টের সংসারের জন্য অনেক বড় একটা ঘটনা ছিল। আব্বার বিষাদমাখা মুখটাতে হাসি ফুটল অনেকদিন পর। কতদিন পর নতুন একজন মানুষ আসলো আমাদের সংসারে ! প্রতি রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আব্বা টিপু সুলতানের গল্প শুনান তাকে। ঠিক ছয় বছর আগের মতন। এতটুকু ক্লান্তি নেই তার চোখে মুখে ! আমি দরজার বাইরে দাড়িয়ে চুপচাপ শুনতে থাকি সব, আড়চোখে দেখি মাঝে মাঝে। বাবলুটা আমার মত হয়নি একদম। বিরক্তিকর গল্প শুনতে তার খারাপ লাগে না একটুও। চোখমুখ শুকনো হয়ে যায় না। বরং দুই তিনবার করে শুনতে চায় একেকটা গল্প। আর গল্প শেষে দুই হাতের দুটো আঙুল মাথার উপর উঁচু করে ধরে। আব্বাকে জিজ্ঞেস করে, "বাবা, টিপু সুলতানের কি এইরকম শিং ছিল?"। আব্বা হতভম্ব হয়ে যান একদম। মুখ দিয়ে টু শব্দটাও বের হয় না। আমি দূর থেকে দেখি সব। কি অসাধারণ একটা মুহূর্ত ছিল ! শুধু যদি কোনভাবে ওই মুহূর্তটাকে ধরে রাখা যেত ! কিংবা সময়টাকে থামিয়ে দেয়া যেত কোনভাবে !

অবশ্য আমার মত তুচ্ছ মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছায় জগৎ সংসারের সময় থেমে থাকে না। সময় বরং চলে যায়, চোখের নিমিষে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ঢাকায় ভর্তির সুযোগ পেলাম। মফস্বল শহরের হাবাগোবা ছেলেটা ঢাকায় গিয়ে কই থাকবে, কি খাবে, এইসব হাবিজাবি চিন্তায় আব্বার ঘুম হলো না কয়েকদিন। আমি বুঝালাম অনেক। কাধেঁ হাত রেখে সাহস দিলাম, বললাম আমাকে নিয়ে চিন্তা না করতে। শেষমেষ কিছুটা শান্ত হলেন মনে হয়। আর আমি একবুক কষ্ট নিয়ে ব্যাগ গোছাতে লাগলাম। ঢাকায় আসার আগের রাতে বাবলু ঘুরঘুর করছিল আশেপাশে, আব্বাও নানা ছুতোয় দুই একটা অপ্রয়োজনীয় কথা বলে নিচ্ছিলেন। আমি ব্যাগ গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি। কিন্তু সেই রাতে আমার ঘুম হলো না একটুও। বারবার মনে পড়ছিল বাবলুর কথা, আব্বার কথা। বাবলু আমার পাশেই ঘুমিয়ে ছিল, খোলা জানলার দিকে মুখ করে। চাঁদের আলো এসে পড়ছিল ওর চোখে মুখে। ওর নিষ্পাপ মুখটার দিকে তাকিয়ে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল খুব, চোখের কোণে পানি জমল আরেকবার।

৪.

বড্ড বিচিত্র একটা জগৎ আবিষ্কার করলাম ঢাকায় এসে। নিরানন্দ আর নিষ্ঠুর একটা শহর। চারপাশের মানুষগুলোর ব্যাস্ততা সীমাহীন ! অন্য কাউকে নিয়ে ভাবার বিন্দুমাত্র সময় নেই তাদের। শুধু আমার কোন ব্যাস্ততা ছিল না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ক্লাসে চলে যেতাম। ফিরতাম একদম দুপুরে। বিকেলের সময়টা নিঃসঙ্গ কাটতো খুব। কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে তখন ক্যাফেটেরিয়ায় চলে যেতাম। একদম কোণার টেবিলটাতে গিয়ে বসতাম, যেখানে আর কেউ বসত না। তারপর গরম এককাপ চা আর ডালপুরীর অর্ডার দিতাম। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা থেকে বিভূতিভূষনের "অপরাজিত" বইটা বের করতাম। দুই একটা পাতা উল্টে পাল্টেও দেখতাম মাঝে মাঝে। কোন কোনদিন আবার হাঁটতে বের হতাম। শহীদ মিনার, টিএসসি, রমনা পার্ক কিংবা সোরওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম। চারপাশের সুখী মানুষগুলোকে দেখে হিংসা হত ভীষণ। খুব সম্ভবত তাদের কারো জীবনে এতটুকু অপূর্ণতাও ছিল না!

তবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা আমার নিজেরও খারাপ কাটেনি একেবারে। মাঝে মাঝে শুধু বাসার কথা মনে পড়ত। বাকি সময়টা ভালোই ছিলাম। সেকেন্ড ইয়ারে উঠে শায়লা নামের একটা মেয়েকে ভালো লেগে যায় ভীষণ। আমাদের সাথেই পড়ত। একটা প্রজেক্টে কাজ করার সময় একি গ্রুপে ছিলাম আমরা। সেই সূত্রে পরিচয়। কিন্তু ভালো লাগার কথাটা তাকে বলার মতন সাহস আমার ছিল না। আমি তাই নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলাম। বুকে পাথর বাঁধলাম। তাতে অবশ্য খুব একটা লাভ হলো না। ভালো লাগাটা বরং বাড়তে লাগল দিন দিন। আর আমি নিজের ভেতরে স্বপ্নের জাল বুনতে লাগলাম, একটু একটু করে। কোন এক বিকেলে হয়ত শাহবাগের মোড় থেকে লাল টকটকে গোলাপ কিনব কয়েকটা। তারপর খুব উদাস মুখ করে ভালো লাগার কথাটা বলব শায়লাকে। শায়লার ভীষণ অভিমান হবে তখন। ভালো লাগার কথাটা তাকে আগে বললাম না কেন, সেইজন্যে ! তারপর একদিন বিয়ে হবে আমাদের, আর থাকবে ঘরভর্তি বাচ্চা-কাচ্চা !

আমার কল্পনার রাজ্যে ডালপালা গজাতে থাকে দ্রুত। স্বপ্নগুলো বাড়তে থাকে দিন দিন। কিন্তু একদিন সবকিছু ভেঙেও যায় আবার। চৈত্রের এক বিকেলের ঘটনা। সারাদিনের কাজ শেষে শায়লা হাসি হাসি মুখ করে বলল, "দোস্ত, কাল একটু সকাল সকাল আসিস্‌, অনেক কাজ বাকি এখনো"। আমার ভেতরটা ভেঙেচুরে খান খান হয়ে যায় তখনি। এই "দোস্ত" শব্দটা শুনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। অনেক কষ্টে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, "ঠিক আছে"। কিন্তু ততক্ষনে আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরন শুরু হয়ে গেছে। আর আমার এতদিনকার যত স্বপ্ন, সব শেষ হয়ে গেছে নিমিষে!

আমি খুব আশাবাদী মানুষ ছিলাম। ছোট্ট এই জীবনটার উপর দিয়ে কত ঝড় বয়ে গেছে ততদিনে ! কিন্তু হতাশ হইনি কখনো। এবারও তাই হাল ছাড়লাম না। শায়লার আশেপাশেই ঘুরঘুর করতে লাগলাম। ক্যাফেটেরিয়ায় বসে গল্প করতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। আর পড়ন্ত বিকেলে একসাথে হাটতাম ক্যাম্পাসের ভেতর। আমিই বকবক করতাম বেশির ভাগ সময়। শায়লা চুপ করে থাকত, কি যেন ভাবত সবসময় ! আমাদের দুইটা বছর এভাবেই কেটে গেল। তখনও আমাদের সম্পর্কটা ছিল শুধুই "বন্ধুত্বের"। কিন্তু আমি আর পারছিলাম না। এক প্রচন্ড বৃষ্টির দিনে, শেষ বিকেলে যখন চারপাশটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল একদম, আমি আমার মনের কথাটা বলে ফেললাম শায়লাকে। শায়লার মুখটা মেঘে ঢেকে গেল মূহুর্তে ! চোখ দুটো নামিয়ে নিল সে। আর জানিয়ে দিল এ হবার নয়। নিজের উপর করুনা হল ভীষণ। আমার ভাগ্যটাই আসলে খারাপ। কাউকে ধরে রাখার মতন ক্ষমতা দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয় নি আমাকে!

পাশ করার পর সবকিছুর প্রতি কেমন জানি একটা বিতৃষ্না জন্মাল। অসহ্য মনে হতে লাগল সবকিছু। বন্ধুবান্ধবদের একটা বড় অংশ দেশের বাইরে যাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। আর আমিও সব পিছুটান অগ্রাহ্য করে দেশ ছাড়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলাম। একাডেমিক রেজাল্ট ভালোই ছিল আমার। একটা স্কলারশীপ ম্যানেজ করতে খুব বেশি কষ্ট হল না তাই। আস্তে আস্তে সব গুছিয়ে নিলাম। একদিন সব ছেড়ে চলে যাবার জন্য এয়ারপোর্টে গিয়ে হাজির হলাম। বাবলু সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল অঝোরে। আব্বার চোখ দুটোও টলমল করছিল পানিতে। আর আমার বুকের ভেতরে কোথায় জানি তীব্র ব্যাথা হচ্ছিল। কিন্তু ততদিনে আমার জানা হয়ে গেছে, "পিছুটান" আমাকে কষ্ট দিবে শুধু। আমি তাই সব পিছুটান অস্বীকার করে প্লেনে চেপে বসলাম। একবুক কষ্ট নিয়ে দেশ ছাড়লাম !

৫.

গরম এক মগ কফি বানিয়ে জানলার পাশে গিয়ে বসলাম। আমার অ্যাপার্টম্যান্টের জানলা থেকে বাইরের তুষারপাতের দৃশ্যটা দেখতে অসাধারন লাগে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি আমি। মনটা খারাপ হয়ে যায় তখন। এরকম একটা মুহুর্তে আমার আজ একা থাকার কথা ছিল না। অন্তত কেউ একজন পাশে থাকার কথা ছিল, যার হাত দুটো মুঠোয় পুরে বুকের ভেতরের জমানো কষ্টগুলোর কথা বলতে পারতাম ! কিংবা যার দীঘল কালো চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে সব কষ্ট ভুলে থাকতে পারতাম মুহুর্তের জন্য ! আমার জীবনটা এমন হয়ে গেল কেন কে জানে ! গত সাত বছরে একটাবারের জন্যও দেশে যাওয়া হয় নি। আব্বা যেদিন মারা যান, সেদিন সব গুছিয়ে নিয়েছিলাম, দেশে যাবার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয় নি। আব্বার হাসিখুশি আর জীবন্ত মুখটাই স্মৃতিতে থাকুক! হতভম্ব আর অপ্রস্তুত হয়ে যাওয়া মুখটাই মনে থাকুক সারাজীবন ! আমার আদরের ছোট্ট ভাইটা কেমন আছে তাও জানিনা ! ওর সাথে কথা হয় না আজ অনেক দিন। ইদানীং খুব দেখতে ইচ্ছে করে ওকে, এতদিনে নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে। শায়লার কথাও মনে পড়ে মাঝে মাঝে। ঘরভর্তি বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে নিশ্চয়ই অনেক সুখে আছে ও। আর সবচাইতে বেশি মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা, যখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামত। আর আমি জানলা দুটো খুলে দিতাম। হু হু করে ঠান্ডা বাতাস ঢুকত সেখান দিয়ে। আম্মা বকা দিতেন ভীষণ। কিন্তু আমি শুনতাম না একটুও। বুক ফেটে কান্না আসে আমার। টেবিলের উপর মাথাটা রেখে কাঁদতে থাকি অঝোরে। কিন্তু এই পাষাণহৃদয় মানুষটার কান্না দেখার মতন সৌভাগ্য কারো হয় না !   


-এবিএম
 ০৬/০৪/২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন